দিকের সাহিত্য | দৈনিক দিকের বার্তা
গাজার শেষ বাতিঘর
শফিকুল মুহাম্মদ ইসলাম
১
ভোর পাঁচটা। গাজার এক চিলতে ধ্বংসস্তূপের নিচে নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে এক কিশোর—নামের আগে বা পরে কোনো পদবী নেই। তার নাম—আমান। দশ বছর বয়স। বাবা ছিল এক মাছ বিক্রেতা, মা সেলাইয়ের কাজ করতেন। এখন দুজনেই নামহীন কবরের বাসিন্দা।
গোটা গাজা এখন যেন এক শ্মশান, শুধু আগুন নেই, আছে ধোঁয়া আর শোক।
শুধু জীবিতরা মরেনি, মরেছে স্বপ্ন, মরেছে শৈশব।
২
আমান এখন তার ছোট বোন রাহাফকে কোলে নিয়ে বসে আছে। রাহাফের মুখে একবিন্দু খাবার নেই তিন দিন। মায়ের বুকও শুষ্ক। কেননা মা আর বেঁচে নেই।
খাবারের প্যাকেটগুলো পড়ে আছে ধ্বংসস্তুপের ওপারে, সেখানে পৌঁছাতে গেলে আকাশ থেকে গুলি নামবে—দেখা গেছে আগেও।
তবুও আমান জানে, খাবার আনতেই হবে, রাহাফ না খেলে…
তার ছোট্ট হাতের আঙুলগুলো আজ অবশ।
কিন্তু সে বাঁচলে হয়তো একদিন জানবে—মানুষ কীভাবে পশুর চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।
৩
- আমান ভাবে, রাত হলে বের হবে—আকাশের চোখ তখন ঘুমায় না বটে, তবে জোনাকি পোকাগুলো একটু আলো দিতে পারে।
গাজার আলো আজ কেবল এসব ছোট প্রাণীদের চোখে।
বাকি সব আলো নিভে গেছে, ড্রোনের গর্জনে।
৪
একদিন তাদের ঘরে একটা ছোট লন্ঠন ছিল, যে লন্ঠনের পাশে বসে মা কোরআন পড়তেন।
লন্ঠনের আলোয় বাবা বলতেন—"আমরা ফিলিস্তিনি, আমরা মরে গিয়েও বেঁচে থাকি।"
আজ সেই লন্ঠনটিও হারিয়ে গেছে।
তবুও, আমান ভাবে—সে-ই হবে গাজার শেষ বাতিঘর।
৫
গোটা গাজা এখন নীরবতার শহর।
তবু এই নীরবতাও প্রতিদিন কাঁদে—বিস্ফোরণের শব্দে, লাশের গন্ধে, বেঁচে থাকা মানুষদের হাহাকারে।
মানুষ আর পশুর পার্থক্য বোঝা মুশকিল।
শুধু জানোয়াররা মারে ক্ষুধার্ত মানুষদের?
৬
একদিন আমান একটা ভাঙা রুটি খুঁজে পেলো।
তাও ভাগ করে দিলো রাহাফের সঙ্গে।
সেই রাতে রাহাফ বলল—"ভাইয়া, আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি। মা আবার ফিরে এসেছে।"
আমান তাকিয়ে থাকে রাহাফের দিকে।
সে জানে, স্বপ্ন এখন কেবল মৃতদের একচেটিয়া সম্পদ।
৭
পরদিন আকাশে বোমারু বিমান।
তারা আবার এসেছে। আবার রক্ত, আবার ধ্বংস।
একটি শিশু গুলিতে মারা গেছে।
নাম—ইয়াহিয়া।
আমানের খেলার সাথী ছিল।
আমান কিছু বলে না।
শুধু মাটির নিচে তার নাম লিখে রাখে ছোট একটি কাঠি দিয়ে।
কারণ এখানে কবরও জায়গা পায় না।
৮
রাতে রাহাফ জিজ্ঞাসা করল,
— ভাইয়া, আমরা কবে স্কুলে যাব?
— আমান বলল, “যদি বেঁচে থাকি, তুমি যাবেই।”
কিন্তু আমান জানে, তাদের স্কুলটা আজ সকালে উড়ে গেছে।
সেই ইসরায়েলি বিমান ওড়ায়নি কোনো পাখি—ওড়ায় মৃত্যুর বার্তা।
৯
এক সন্ধ্যায় আমান তার ভাইকে নিয়ে কাতারের সহায়তা কেন্দ্রে পৌঁছায়।
কিন্তু সেখানে গেট বন্ধ।
এক বৃদ্ধ আর্তনাদ করে উঠলেন—"তোমাদের কি হৃদয়ও পাথরের হয়ে গেছে?!"
কেউ উত্তর দেয় না।
কেবল আল জাজিরা'র ক্যামেরা ঘোরে।
মানবতা ও মিডিয়া—দুই জিনিসই শকুন হয়ে গেছে।
১০
একদিন হয়তো আমানও আর থাকবে না।
হয়তো কোনো গর্তে পড়ে যাবে তার দেহটা।
কিন্তু এক স্লেটের ভেতর লেখা থাকবে তার নাম—"আমান ইবনে ফিলিস্তিন।"
আর লেখা থাকবে,
"আমি ছিলাম গাজার শেষ বাতিঘর।
যতক্ষণ বেঁচে ছিলাম, আলোর আশা ছাড়িনি।"
_________________________
লেখকের ঠিকানা:
বাউশাম, কলমাকান্দা, নেত্রকোনা
shafiquemppg@gmail.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন